জেনে নিন এই ৬টি কাজ করলে অভাব থাকবে না পেঁয়াজের
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেই অস্থির হয়ে উঠে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। পেঁয়াজের দাম বেড়ে হয়ে যায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। আবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি করবে শুনলেই কমে যায় দাম। ২০১৯ সালে ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল, দেশে তখন এর দাম রেকর্ড তিনশো টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদার প্রায় ৫৭ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণেই পেয়াঁজের ব্যাপারে ভারত কোন সিদ্ধান্ত নিলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। এর বাইরে মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, চীন থেকেও বাংলাদেশে অল্প কিছু পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে।
কৃষি প্রধান দেশ হয়েও বাংলাদেশ এখনো পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই প্রশ্ন আসতেই পারে, দেশের পেঁয়াজের চাহিদা দেশেই কীভাবে মেটানো সম্ভব? এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। বাংলাদেশের কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো।
২০২০ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। তবে এই উৎপাদন থেকে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে। অথচ বাকি চাহিদা পূরণ করতে প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনটিতে কৃষি প্রধান একটি দেশ হয়েও পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ করতে না পারার পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বীজের অভাব বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য পেঁয়াজের ভালো ও উন্নত বীজের অভাব রয়েছে। পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়াতে হলে এই বীজের উৎপাদন এবং সংরক্ষণও বাড়াতে হবে।
সমন্বিত চাষাবাদ ঘাটতি ১০ লাখ টন পূরণ করার জন্য বাড়তি জমিরও দরকার হয় না। দেশে যে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়, সেখানেই ভালো জাত আর উৎপাদন কলাকৌশলে পরিবর্তন আনলে, কৃষকদের একটু প্রশিক্ষণ দিতে পারলেই চার-পাঁচ লাখ টন উৎপাদন বাড়ানো যাবে।
দামের ওঠানামা পেঁয়াজ চাষাবাদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো এর দামের ওঠানামা। কখনো কৃষক চাষাবাদ করে লোকসানের মুখে পড়েন। আবার কখনো অতিরিক্ত দামের কারণে বীজ পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন।
গতবছর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কৃষক অক্টোবর মাসে তাদের পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে অনেক কৃষক এই বছর বীজ খুঁজে পাচ্ছেন না। পেঁয়াজের দামটা জেনো সহনীয় থাকে, সেজন্য দেশে নীতিমালা দরকার, যাতে কৃষক এই ফসল উৎপাদন করে হতাশ হয়ে না পড়েন।
সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাংলাদেশে শুধুমাত্র পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোন কোল্ড স্টোরেজ নেই। কিন্তু সারা বছরের চাহিদা মেটানোর মতো পেঁয়াজ উৎপাদিত করতে হলে সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বর্তমানে কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন।
কিন্তু তাতে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার হারটা বেশি হয়। পেঁয়াজের জন্য ১২ থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের তাপমাত্রা দরকার। আর্দ্রতা থাকতে হবে ৩৫ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ীর মতো যেসব স্থানে পেঁয়াজের আবাদ বেশি হয়, সেখানে এরকম অনেকগুলো কোল্ড স্টোরেজ থাকলে কৃষকরা পেঁয়াজটা সংরক্ষণ করে রাখতে পারতেন। ফলে তারা বেশি করে উৎপাদন করতে পারবেন।
গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে পেঁয়াজের ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। তার মধ্যে তিনটি জাত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত। সেগুলোর ভেতর বারি-৫ এর ওপর গবেষণাকারীরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন।
মার্চ মাসে রোপণ করে জুন-জুলাই মাসে অথবা আগস্ট মাসে রোপণ করে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এসব পেঁয়াজের ফসল পাওয়া যায়। কিন্তু সংরক্ষণ ক্ষমতা কিছুটা কম হওয়ায় এসব পেঁয়াজের জাত এখনো কৃষকদের কাছে ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
তবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষাবাদ আস্তে আস্তে বাড়ছে। আরেকটি পেঁয়াজ হচ্ছে মুড়িকাটা পেঁয়াজ, যেটা অক্টোবরে লাগালে ডিসেম্বর নাগাদ ফসল পাওয়া যায়। কিন্তু এই পেঁয়াজের এখনো অনেক অভাব রয়েছে।
চরের জমি অন্তর্ভুক্ত করা গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ চর এলাকা রয়েছে। সেসব জমি যদি পেঁয়াজ উৎপাদনে কাজে লাগানো যায়, তাহলেই পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদার ১০ লক্ষ টনের পুরোটা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে সেজন্য পেঁয়াজ উৎপাদনের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। তাহলেই কৃষকরা পেঁয়াজ চাষাবাদে আগ্রহী হবেন।
সব সমস্যা দূর হলে ঘাটতি মেটাতে কতদিন লাগবে? গবেষকরা বলছেন, পেঁয়াজ চাষাবাদে বীজের অভাব, সংরক্ষণ ব্যবস্থা, দাম নির্ধারণ- ইত্যাদির মাধ্যমে হয়তো একবছরেই রাতারাতি ঘাটতি পূরণ হবে না। কিন্তু সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা আর উদ্যোগ কয়েক বছরের মধ্যেই পেঁয়াজের ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, দামটা যদি অন্তত উৎপাদন মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে রাখা যায়, সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা যায় আর শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন বীজের পর্যাপ্ত যোগান দেয়া যায়, তাহলে আগামী পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারবো।